লেখার ডাগর মাঠ


শনিবার, সেপ্টেম্বর ১৬

লজ্জা

।। লজ্জা ।। অনুগল্প ।।
দেবজ্যোতিকাজল

সেদিন দুপুর বেলা রোহিত শেষ গানটা গেয়েছিল , “ আমার মুক্তি আলয়....” 
রোহিত আজ বৃষ্টির মত ঝড়ে পড়ছে । গানের অর্থ রোহিতের চোখ ধুয়ে দিচ্ছে । বুকের মধ্যে আদর মাখা বিরামহীন সুরের শব্দগুলো নগ্ন বুক কে ভিজিয়ে দিচ্ছে । রোহিত বুঝতে পারল । দেশ বদলে গেলে কষ্টও বদলে যায় । আজ রোহিতের দেশ ত্যাগের বিদয়ি জন্মদিন পঁচিশতম বছর । রোহিত আজ সারাদিন একা একটা ঘরে বসে বসে গান গাইবেন । নিজের চোখের জল কে আড়াল করতে ।

তখন একাত্তরের যুদ্ধ চলছিল ।  রোহিতের বয়স তখন পাঁচ । পথের মাঝে পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ি দেখে । রোহিতরা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে গিয়েছিল ।  আর কিছু লোক বাঁচার জন্য দৌড়াচ্ছিল । কোথা থেকে একটা গুলি এসে রোহিতের দু’পায়ের এফোড়-ওফোড় হয়ে যায় । তারপর থেকে রোহিত প্রতিবন্ধী ।

রোহিত 1993 সালে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে প্রতিবেশি দেশে চলে আসে । তার আগের বছরে বাবরিমসজিদ নিয়ে তার জন্মভূমিতে সাম্প্রদায়িক তান্ডব হয়ে যায় । বেশ কিছুদিন জুড়েই তান্ডবটা চলেছিল । যদিও রোহিতদের শহরে তেমন কিছু হয়নি সে বার। যদি হতো তবে রোহিতের কি হতো কে জানে । রোহিতের এক মুসলিম বন্ধু অবশ্য বলেছিল , “ কিছু হলে আমার বাড়িতে চলে আসিস্  ।” রোহিত এই পালিয়ে বাঁচাকে মেনে নিতে পারে নি । তাই কিছু হতে পারে ভেবেও রোহিত বাড়ি ছেড়ে কারু বাড়িতে আশ্রয় নেয় নি । সে যাত্রায় অবশ্য কিছু হয় না । তবুও বেশ কিছুদিন একটা মানসিক ভয়ের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল ।

রোহিত ঘরে বসে বসে রেওয়াজ করছিল । এটা রোহিতের প্রতিদিনের নিয়ম । তখন বিকেল পড়ন্ত বেলা । হঠাৎ দরজার শব্দে রোহিতের সুর থেমে যায় । দরজায় তাকাতেই বাবাকে দেখতে পায় । রোহিতের বাবা পাশের চেয়ারে বসে রোহিতের দিকে তাকায় । রোহিত তরল সুরে বলে ,“ কি ব্যপার , কিছু বলবে ?”

কথাটা শেষ করে বাবার মুখের তাকিয়ে । তারপর গানের খাতাটা বন্ধ করে ।
এ দিকে রোহিতের বাবা চাপা কন্ঠে রোহিতকে বললো , “ হুম । তোর সাথে কিছু কথা আছে । 

রোহিত বাবার দিকে তাকিয়ে বলল ,“ বলো ...”

রোহিতের বাবা ক্ষেদযুক্ত গলায় বলল,“ রোহিত এদেশে আর থাকব না ?”

রোহিত চমকে উঠে । বাবার চোখের দিকে গোলগোল করে তাকিয়ে বললো ,“ কোথায় যাবে ? কেনো কি হয়েছে । হঠাৎ এসব বলছো ?”

-“ ভারতে চলে যাব ।” কথাটা বলে বড়ো করে একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলো রোহিতের বাবা ।

রোহিত বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো , “ কেনো ?”

-“ আমাদের শহরে যদি কখনও জাতিগত দাঙ্গা হয় । তবে আমরা তোকে বাঁচাতে পারব না । তাই আমি ভেবেছি এদেশে আর থাকব না ।”

রোহিত আর কিছু বলতে পারে নি । কয়েক দিন আগের ঘটনায় রোহিত ভীত । জন্মভূমিতে এই অনিশ্চিত জীবনকে রোহিত মেনে নিতে পারে না । স্বাধীন দেশ । তবে কেনো পরাধীনতার গ্লানি পায়ে পায়ে চলবে ! কেনো নাগরিক অধিকার নিয়েবাঁচা যাবে না ! কেনো এক বিশেষ জাতিকে টার্গেট করা হবে অন্যায় ভাবে ! তাই রোহিত বাবাকে “ না ” বলতে পারে নি । 

রোহিত জানত না । কিভাবে এত বড়ো সত্যকে সহজেই মেনে নিতে হয় । বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে তার জন্মভূমি বাংলাদেশ ক্ষেপেছিল । রোহিত হিসেব মিলাতে পারে নি । কেনো এই তান্ডব হয়েছিল । বাবরি মসজিদ তো ছিল ভারতের ব্যপার । তবে.....কেনো রোহিতের জীবনকে অনিরাপদ করেছিল ? হিসেব নেই । উত্তর নেই । এই সব সহজ সরল প্রশ্নের । তবুও উত্তর খোঁজে রোহিত । 

আজ রোহিতের দেশ ত্যাগের বিদায়ি জন্মদিন ছিল । এই দিনে রোহিত সারা দিন মুক্তির গান গায় । শিকল ভাঙ্গার গান গায় । সব শেষে চোখের অশ্রু দিয়ে বিদায়ি জন্মদিনের সমাপ্তি টানে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন