লেখার ডাগর মাঠ


বৃহস্পতিবার, মার্চ ২

ফুলের গায়ে রক্ত

ছোটগল্প
ফুলের গায়ে রক্ত
দেবজ্যোতিকাজল

এক

এমন সকাল আমি কখনও দেখিনি । ঘন কুয়াশা এ-শীতে এই প্রথম । সূর্যের দেখা নেই  । চোখের সামনে ঘষা কাঁচ দৃষ্টি ঝুলে আছে । শরীরটা ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে । শীতের দিনগুলো বেশির ভাগ আমার এমনি যায় । ঠাণ্ডা  একদম সহ্য করতে পারিনা । তারপর যদি সূর্য বন্দি হয়ে যায় মেঘের বাক্সে তবে তো আমি সিনিয়র সিটিজেন বনে যায় ।

তারমধ্যে আজকে আবার রাতে  বুকচাপা স্বপ্ন দেখেছি । কি স্বপ্ন দেখেছি ? হুম । ইয়াং বয়সে ঘুমে ঘোরে যা আসে । গোলাপী রঙের ফুল তোলা নাইটি পরিহিতা । সৌন্দর্য্যে রাগীতবিহীন । অনেকটা সদ্য ফোটা ভোরের ফুল ।ভাবনায় এলোমেলো ধাক্কা দেয় । বুকে একদম গভীরে টের পেলাম । জীবনানন্দ প্রেমময় কবিতা মুখ । ঠোঁটে ম্লান হাসি হেঁটে চলে । নিঃশব্দে হাঁটে ।  আমার রক্তে । বিরাট একটা লালচে সে চরে কৌতূহলোদ্দীপক মুগ্ধতা নাড়াচাড়া করে । তাতে রস আছে । মন আছে । ভালোলাগা আছে । চোখ ডলা পরিস্কার দেখা আছে । তৃপ্তি আছে । নাই শুধু তাতে অতৃপ্তি জীবন-বোধ ।

মেয়েটা কে দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল হয়তো বা কোন বাজে মেয়ে-টেয়ে হবে । ভাবতেই হাসি পেল । স্বপ্নে আবার বাজে মেয়েদের চেনা যায় নাকি ? মেয়েটা বলিষ্ঠ শিম্পাঞ্জির সাথে লড়ছে । শিম্পাঞ্জি মেয়েটাকে কি করতে চায় ? ঘটনার অঘটনে আমি স্বপ্নের মধ্যে  দর্শক । কি অদ্ভূত ভাবে শিম্পাঞ্জিটা মেয়েটাকে ধরেছে । বলিষ্ঠ শরীর । মেয়েটির প্রতি শিম্পাঞ্জিটা আত্মনিমগ্ন । মেয়েটিও নিশ্চল ভাবে পরে আছে । বাঁচার কোন আত্মচিৎকার নেই । কে কোথাও আছো আমাকে বাঁচাও । কি অদ্ভূত মেয়েরে বাবা । নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের মত স্থবির হয়ে পড়ে আছে ।আমি হতবাগ হয়ে শিম্পাঞ্জিটার লকলকে জিভ আর হিংস্র চোখ দুটো দেখে ভয়ে কুকড়ে গেলাম । আতঙ্কে ডাকবাংলার দরজা খুলে ভাবছিলাম কি করব । একবার ভাবলাম চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডেকে তুলি । না , তা হয় না । শিম্পাঞ্জিটা জেনে যাবে । হয়তো নিজেকে বাঁচাতে আমদের উপর আক্রমন হানাবে । আমি নিজের মধ্যে সাহাস সঞ্চার করলাম । টিপটিপ করে হেঁটে জানলার ফাঁকে উঁকি  মারলাম ।

মেয়েটা কাছ থেকে একটা অস্পস্ট শব্দ ভেসে এলো । অন্ধকারে কান পেতে কথাটি বোঝার চেষ্টা করলাম । কিন্তু না , বুঝতে পারলাম না । শিম্পাঞ্জিটা মেয়েটাকে চেপে ধরে আছে । চেপে ধরে মুখ দিয়ে কি একটা যেনো করছে । ও মাই গড । আমার শরীরটা ভয়ে ভারি হতে লাগল । যাহ্ এ কি দেখছি । এও কি  সম্ভব ! ততক্ষনে মেয়েটির সারা শরীরের পোষাক খোলা হয়ে গেছে । মেয়েটি সম্পন্ন উলঙ্গ । নিশ্চল মেয়েটি কি তাবে মৃত । ভাবতেই বুকের মধ্যে মায়া আর ভয়ের একটা মিশ্রন খেলে গেল । মাথার মধ্যে হাজার  রকমের প্রশ্ন পীড়া দিতে লাগল । হঠাৎ মেয়েটা নড়ে ওঠলো । আমার শরীরের মধ্যে একটা নতুন পরিবর্তন স্বভাবগত সাড়া দিল । আরে ...যাঃ ! শিম্পাঞ্জি মেয়েটাকে চুমু দিতে লাগল । লকলকে জিভটা দিয়ে কেমন একটা কদাকার ভাব করতে লাগল । মেয়েটি উত্তেজনায় ছটফট করছে । হালকা গোঙানি শব্দে আমার সমস্ত কানকে ঝাঁঝিয়ে তুলল । কি একটা বীভৎসোতায় বয়সী ঝড় শরীরকে ঈঙ্গিত করছে । আমি ভাষা ও সাহস হারাতে লাগলাম । শিম্পাঞ্জি মেয়েটার উপরে ওঠে কেমন যেনো একটা ভাব করে মেয়েটার আঙুলের মধ্যে নীজের আঙুল গুজে দিয়ে গরগর করতে লাগল । তবে কি ! না না এ হতে পারে না । শিম্পাঞ্জি তো এইডস্-এর জীবাণু বহন করে । মানুষের শরীরে  প্রথম এইডসের জাম নাকি শিম্পাঞ্জি সঙ্গে দৈহিক মিলনের ফলেই এসেছে । আমি চাপা চিৎকারে নাইট গার্ড কে ডাকলাম । নাইট গার্ড আমার কাছে আসতেই গুলি করতে বললাম । নাইট গার্ড পরপর দু’টো গুলি করল । শিম্পাঞ্জি গোঙাতে গোঙাতে মাটিতে পড়ে গেল । কিন্তু মেয়েটি তো নড়ছে না ? তবে কি গুলিটা দুজনেরই লেগেছে ? আমি পাশে তাকিয়ে দেখি বেশ কয়েক জন চলে এসেছে । দরজা ভেঙে ঘরের মধ্যে ছুটে গেলাম ।

মেয়েটার নিম্নাঙ্গে দিয়ে ততক্ষনে দরদর করে রক্ত ঝড়ছে । ঠোঁট দু’টো লালায় ভর্তি । শরীরের কতকগুলো জায়গায় তীক্ষ্ন নখের দাগ । মসৃণ হয়ে পরে আছে মেয়েটি । অনেক পুরোন রাজবাড়ির মত । আমি আরও একবার অনুসন্ধানী চোখে মেয়েটির দিকে তাকালাম । তারপর শিম্পাঞ্জিটির দিকে । শিম্পাঞ্জির বড়বড় লোমগুলো রক্তের দাগে ছোপছোপ লাল হয়ে আছে । লোমগুলোকে বাদ দিয়ে ভাবলে দানবাকৃতির মত একটা মানুষের মুর্তি চোখের সামনে ভেসে ওঠে । আমি মাঝে মাঝেই আতকে উঠছি । মনে হলো আমাকেও ডাকছে । ভয়ে আমার শরীরটা পালিয়ে যাবার ইঙ্গিত করছে । আমি বুঝতে পারলাম ঘুমের মধ্যে আমার মুখ থেকে চাপা গোঙারানির আওয়াজ বেরচ্ছে ।

“ অনিক , এই অনিক । আরে অমন করছ কেনো  ।”- আমার গায়ে হাত দিয়ে আমার বৌ ডাকল ।

আমি আলতু করে চোখটা খুলে মাথা বেকিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ,আমার স্ত্রী । মাথাটা বালিশে রেখে ঠোঁট দুটো চেপে ধরে টানা একটা নিশ্বাস নিলাম । স্বপ্নের ঘোরটা মাথা আর মনে মধ্যে চেপে বসে আছে বুঝতে পারলাম । বিছানা থেকে উঠে লনের চেয়ারে বসলাম । সামনেই খবরের কাগজ ছিল । হাতে নিয়ে সেন্টার টেবিলে রেখে দিলাম । না । একদম ভাল্ লাগছে না । কেনো জানি স্বপ্নের ঘোরটা আমাকে প্রতিদিনের রুটিন থেকে বিচ্ছিন্ন করছে । আমার স্ত্রী সামনের চেয়ারে এসে বসল । আমি বরিষার দিকে তাকালাম । এলোমেলো লাগছিল বরিষাকে । বরিষার চোখের দিকে তাকালাম । বরিষাও আমার দিকে তাকাল । বরিষা উঠে গিয়ে তিন চার মিনিট পর এসে আবার আমার সামনের চেয়ারটায় বসলো । বরিষাকে উদাসীন উদাসীন লাগছে । বুঝতে পারলাম কিছু একটা হয়েছে । তা না হলে কিছু একটা বলবে । হুম । যা কথা তাই কাজ । বরিষা চাপা একটা ভাষায় বললো,“ অনিক তুমি কি একটা জিনিস লক্ষ করেছ । ”

আমি কথার মনে বুঝতে পারলাম না । কেনো জানি বরিষার কথাগুলো গোজামিল গোজামিল মনে হলো । আমি ঠোঁট চেপে হাই তুলে বললাম,“ মানে । তারবপ একটু থেমে ছোট্ট করে বললাম , না ।”

বরিষা আতঙ্ক গলায় চাপা কন্ঠে বলতে লাগল,“ সত্যি অনিক । আজ কাল দেখছি খাওয়া শোয়া ছাড়া তোমার আর কোনো কাজ নেই । দুদিন হলো বাড়িতেই রয়েছ । আর বলছ “না” । আমার কিন্তু ভীষণ ভয় ভয় লাগছে ।”

এই ভয় কথায় আমার বুকের ভিতরটাকে ছমছমে করে দিল । আতকে দিল । বরিষা কিসের ঈঙ্গিত করছে । তবে কি স্বপ্নের শিম্পাঞ্জিটা আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছিল ! আমি কি তবে এসব স্বপ্ন-টপ্ন দেখিনি ? কথাগুলো ভাবতেই বরিষা চেঁচিয়ে উঠলো ।

“এই অনিক কথা বলছ না কেনো । কি হয়েছে ?”

আমি হঠাৎ রকমে শান্ত হয়ে । নিজেকে নিজের মধ্যে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম । এসব কি হচ্ছে আমার সাথে । আমি কি মানসিক রোগি হয়ে যাচ্ছি ? নিজেকে সামলিয়ে বরিষার দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বললাম,“ কি হয়েছে বলতো । সত্যি আমি বুঝতে পারছি না । তুমি কি বোঝাতে চাইছো ।”

বরিষা কৌতূহলী গলায় বলল,“ কি আর হবে  । সকাল থেকে দেখছি আমাদের পূর্ব সাইডের ফ্ল্যাট-এর তিন তলার ঘরগুলোর জানলা তিনদিন হলো বন্ধ দেখছি । কেনো বলতো ....? আমার কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে ।”

“ও এই কথা । হয়তো ভোরে কোথাও গিয়েছে ।”

“না অনিক । আমার সন্দেহ হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে । ওদের জানলা আমি কখনও এর আগে বন্ধ দেখিনি ।”

ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করলাম,“ শেষ জানলা খোলা কবে নাগাদ দেখেছো ?”

“বৃহস্পতিবার । তখন ক’টা হবে । এই রাত দশটা কি সাড়ে দশটা ।”

“তবে হয়তো কোথাও গিয়েছেন ।”-অনিক আস্তে করে বলল ।

“ না না অনিক । আমার ভীষণ রকমের সন্দেহ হচ্ছে । বড়ো-সড়ো একটা কিছু হয়েছে । দেখে নিও । তুমি পুলিশকে খবরটা দাও । ”

বরিষার অতি সন্দেহটা আমার ভাল লাগল না । ও বরাবরই এমন । অল্পতে অনেক কিছু ভাবে ।

আমি হালকা ধমক লাগিয়ে বললাম,“আচ্ছা আচ্ছা তুমি যাও আমি দেখছি কি করা যায় ।
ফুলের গায়ে রক্ত ( পরবর্তি অংশ )

বরিষার কথাগুলো শুনে মনে হলো ও বোধহয় যেনে শুনেই কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছে । মেয়েরা যদিও একটু সন্দেহ বাতিক বেশি । তবুও বরিষার কথায় যুক্তি খুঁজে পেলাম । বরিষার মেজাজটা আজ দার্শনিক দার্শনিক লাগছে । কি সব বলছে বরিষা । এত বিজ্ঞ ভাব এর আগে কখন দেখিনি । আমি আর ভাবতে পারছি না । রাতের স্বপ্ন আর সকালে রবিষার কথা , কোথায় যেনো আমাকে ভাবাচ্ছে । সত্যিই কি কিছু একটা ঘটেছে ! আচ্ছা , ঔ ফ্ল্যাটে দুটো ভাড়েটে ছাড়া আর কেও আছে বলে আমার জানা নেই । হুম । একজন ব্যাচেলারও থাকেন । আর একজন সবে মাত্র বিয়ে করেছেন । ক’দিন হবে ? হাতে গোনা মাস তিনেক । বৌটা কিন্তু ভারি চমৎকার দেখতে । এমন সুন্দরী দ্বিতীয়টি আগে কখনও দেখিনি । কোথায় যেনো বৌটাকে দেখেছি ? অনিক একবারে মনে করতে পারল না । হুম । পাশের দোকানে , ঋতুমতী তুলো কিনতে গিয়েছিলেন । আমিও কি একটা কিনতে দোকানটিতে গিয়েছিলাম । তবে কি ওদের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে ? কি জানি বাবা । হলেও হতে পারে । আজ কাল তো কতই না অদ্ভূত অদ্ভূত ঘটনা ঘটছে মেয়ে ঘটিত । না না এ হতে পারে না । সবে মাত্র ওদের বিয়ে হয়েছে । মেয়েটার কি পুরনো কোনো প্রেম-ট্রেম । হুম হতেও পারে । লোকটা তো সারাদিন অফিসে থাকে ....।

এই অফিস কথা মনে হতেই । বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে চমকে উঠল । শুনেছি লোকটা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার । সোজা আমি ক্যালেণ্ডারে তাকালাম । আজ তিরিশে ডিসেম্বর । ব্যাঙ্কের যাবতীয় হিসেবের দিন । উহু । ডাল মে কুচ কালা হ্যাঁয় । অবশ্যই লোকটার থাকার কথা । তবে কি ব্যাঙ্কের টাকা-পয়সা মেরে  হাওয়া হয়েছেন । কি জানি হতেও পারে । আজ কআল ভাল মানুষের বড়ই অভাব ।

অনিক ভাবনা থামিয়ে । এক সেকেণ্ড বসে রইল না । তাড়াহুড়া করে ঘর থেকে বেরতে বরিষার সামনে পরল ।বরিষাকে পাশ কেটে বাইরে বের হয়ে । লোকটার তেতালার দিকে তাকাল । সত্যি তো জানালাগুলো বন্ধ । বরিষাও অনিকের পিছু পিছু এসে পাশে দাঁড়াল । অনিক কে তেতালায় তাকাতে দেখে । বরিষা হতভম্ব মুখে বলল ,“ কি গো থানায় টেলিফোনটা করেছো ?”

অনিক একদম রবিষার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল ,“ না । (তারপর একটু থেমে ) আচ্ছা রবিষা এমনও তো হতে পারে । লোকটা ব্যাঙ্কের টাকা-পয়সা নিয়ে চম্পট দিয়েছেন ।”

বরিষা সেই কথার পিঠে কোনও মন্তব্য না করে । থমথমে মুখ করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল । কিন্তু অনিক কথা না থামিয়ে বলল ,“ পালাবে কোথায় । ধরা তো পড়তেই হবে । যাবে কোথায় । তাছাড়া জানো বরিষা আজ ব্যাঙ্কের বাৎসরিক হিসার-নিকাষ । অফিস তো খোলাই আছে । ব্যাঙ্কের ভিতরে কাজ চলছে ।

বরিষা এবার যুক্তি দিয়ে উত্তেজিত ভাবে বলল,“ না না । তুমি যা ভাবছ সব ভুল । তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে । আরে বাবা ব্যাঙ্কের টাকাই যদি হাইজাক করবে তবে এতক্ষণে থানা পুলিশ হতো । সকাল সাড়ে দশটার নিউজ আমি টিভিতে দেখেছি । কই , এমন কিছু হয়েছে বলে , বলল না তো ।

টিভি কথাটা শুনতেই ।  অনিক এক প্রকার তেড়ে ঘরে ঢুকে নিউজ চ্যানেল চালালো । বরিষাও অনিকের পাশে বসে একটা তিরস্কার হাসি দিলো । অনিক প্রায় আধা ঘন্টা টিভির সামনে বসে কোন হোদীস পেলনা । বরিষা এবার একঝলক অনিকের মুখের দিকে দ্যাখে । আর গজগজ করে বলে ,“ আর এতবড় ঘটনা যদি সত্যিই ঘটত তবে এতক্ষণ চারিদিকে হৈচৈ পরে যেত । তোমার বিচার বুদ্ধির লোভ পেয়েছে । ভুলে রোগ ধরেছে । 

-চলবে


চলবে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন