লেখার ডাগর মাঠ


বুধবার, নভেম্বর ২২

হিন্দুদের দেশ ছাড়া করতে যে কৌশল নেয়া হচ্ছে দেশে

সম্প্রতি দেশে চলমান ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক হামলার পরিমাণ বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। গত কয়েকমাসে পরপর অনেকগুলো ঘটনা আমাদের টনক একটুও নাড়াতে পারেনি। যদি টনক নড়তোই, তবে হামলাকারীরা সাহস পেতো না। কিন্তু সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠী আগের মতোই মার খাচ্ছে, কেউ সহায় সম্বল ফেলে রেখে বা জলের দরে বিক্রি করে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। আর দুর্বৃত্ত (পড়ুন জিহাদি) হামলাকারীরা তাদের সম্পত্তি দখল করার জন্য নিত্য নতুন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। কখনও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার জিগির তুলছে, কখনও বা ডাকাতির নাম করে পেটাচ্ছে। যেন ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে তারা দেশ ছেড়ে বাঁচে।

সকালে একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে মাথাটা নুয়ে গেল লজ্জায়। এ দেশে কী হচ্ছে এসব? অপূর্ব অপু নামের একজন তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন-

সংগত কারণেই সোসাল মিডিয়াতে নিজের পরিবার অথবা ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে পারোত: পক্ষে লিখিনা বল্লেই চলে। কাল ভোর রাতে দিদির ফোন পেয়ে তড়িঘড়ি উঠে বসি। আমার এ শহরে তাপমাত্রা ২/৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করছে বেশ কিছুদিন ধরে, তাই কম্বলের নিচ থেকে উঠে সম্বিত ফিরে পেতে একটু সময়ই লাগলো; ততোক্ষনে দিদির কল মিসড হয়ে গিয়েছে। আমি গলাটা একটু খাকারি দিয়েই কলব্যাক করি দিদিকে। ওপাশ থেকে দিদির উত্তেজিত কিছুটা কান্না মেশানো কন্ঠে বলে, “অপুরে, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে! রামনগরে ডাকাতি করতে এসে তোর বড়মা, জেঠামশাই সবাইকে খুব মারছে, কোপাইছে!” দিদি বলেই যাচ্ছে, “কি হচ্ছে এসব দেশে, দেশে কোন আইন, বিচার নেই নাকি? মান সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা দায়! কবে থেকে বলছি ওদের ঐখান থেকে চলে আসতে, শুনছেই না! জানিস অপু তোর জেঠামশাইকে নাকি খুব মারছে, পিংকির নাকি রক্ত বন্ধ হচ্ছে না, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি করছে?” আমি কিছুই বলতে পারছিনা, মূক হয়ে গেছি যেন! দিদি বুঝতে পেরে বলে, “তুই দেখ কিছু করতে পারিস কিনা!” বলেই ফোন রেখে দিলো। আমি গায়ের উপরের কম্বলটা সরিয়ে আবছা অন্ধকারে দেয়ালের দিকে তাকি থাকি। মাথার মধ্যে কতো কিছু খেলতে থাকে। রামনগর আমার মামা বাড়ী, জন্মভিটা। রাধা ডাক্তারের (দাদু) বাড়ী, পুরো বোয়ালমারীর সবাই এক ডাকে চিনতো সেই পাকিস্তান আমল থেকে। স্বাধীনতার সময় একদিনে ঐ বাড়ীর উপরে গ্রামের অন্যান্য সবার মতো আমার আত্মীয়দের সহ ২৮ জনকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। যুদ্ধে শহিদ হয় আমার ছোট মামা। টিকাদার মামার যুদ্ধ জয় করে আসার বীরত্বগাঁথা মা, বড়মা, দিদিমার মুখে শুনে বড় হয়েছি। কিন্তু, একজন বীর মুক্তিযাদ্ধার বোনের, স্বামী- সন্তানকে আজ রাতের আধারে বেঘোরে মার খেতে হলো কেনো? দোষটা কার? উত্তরইবা দেবে কে? প্রায় ৩ একর জায়গার উপর আমার মামা বাড়ী। বলতে গেলে পুরনো বনেদী বাগান বাড়ী। এক সময় কাচারি ঘরে মজলিস লেগেই থাকতো।পূজা পার্বনে বাড়ীর সবাই ‘মেয়ে-ছেলে’ মিলে যাত্রা-থিয়েটার করতো। লোকে লোকারণ্য হয়ে যেতো। দূরদুরান্ত থেকে লোক আসতো রাধা ডাক্তারের বাড়ী বলে মাথায় তুলে। যা আজ শশ্মান প্রায়। আমার জন্মের আগেই (মায়ের বিয়ের সময়) আমার টিকাদার (ডাক্তার) মামা রাগে, অভিমানে ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিল! কারন, সেদিন রাতে যারা মুখোশ পরে ডাকাতি করতে এসেছিলো তারা নাকি মামার সাথে কাচারিতে বসে নিয়মিত তাস খেলতো। গত রাতের ঘটে যাওয়া তথা কথিত ডাকাতিও নাকি তেমনই। বড়মাকে একরুমে আটকিয়ে রাখে যাতে করে তাদের না চিনে। সবাই মিলে মুখোশ পরে নির্মমভাবে মারতেই নাকি ব্যস্ত ছিলো। দুই-চারটে মোবাইল আর নাম মাত্র কিছু সোনাদানা নিয়ে গেছে। যাবার আগে বারবার করে শাঁসিয়ে গিয়েছে, “মালাউনের বাচ্চারা বাঁচতে চাস তো তাড়াতাড়ি ভারতে যা।” বড়মার বুকের দুধ খেয়ে আমি বড় হয়েছি। কত আদর করে আমাকে বড় করেছে। বলতে গেলে রামনগরের অনেকে এখনও কনফিউস্ড আমি আসলে কার ছেলে- সুষোমার (বড়মা) না প্রমীলার (মা)। ফোনে বড়মা বেশি কথা বলতে পারেনি; বলেছে- বাবারে…ওরা তোর জেঠামশাইকে যা মারছে না…! লাঠি দিয়ে বাড়াইছে… হাঁটুতে কোপ দিয়েছে…! আমি কি বলবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা! জেঠামশাই পন্ডিত মানুষ, প্রায় সত্তুর ছুঁই ছুঁই করছে এখন, নামকরা একটা ইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। যারা কিনা গতোকাল রাতে তাঁর গায়ে হাত তুলেছে, তারা অথবা তার বাপ/চাচারা যদি কখন স্কুলে গিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই কোন না কোনভাবে জেঠামশাইয়ের ছাত্র ছিলেন কোন সময়ে। আমার বুকের মধ্যে ক্রুদ্ধ বাস্প দলা বেধে উঠে। আমি ছটফট করতে থাকি। এর থেকে উপায় কি? এর শেষ কোথায়? উত্তর খুঁজে পাইনা। স্বাধীনতার পর থেকেই সংখ্যালঘু অথবা মালাউনদের তাড়ানোর এর থেকে সহজ উপায় তো দেখিনা। দেশে সংখ্যালঘুদের পক্ষে কথা বলতে পারার লোকজনও আজ সংখ্যালঘু প্রায়। বাংলাদেশে সৎ ও সম্মানের সাথে বাঁচতে চাওয়া লোকগুলোরও ধর্মিয় সংখ্যালঘুদের মতো অবস্থা। বাংলাদেশ আমার মতো, তাদের কাছেও এক আজীবন ‘যন্ত্রণার’ নাম। বি.দ্র:- ঐ সব থানাপুলিশ, নেতাফেতা দেখা আছে ।
এই ঘটনাগুলো চলছে, প্রতিদিনই, দেশের আনাচে কানাচে। সব খবর জাতীয় পত্রিকায় আসেও না। স্থানীয় পত্রিকায় হয়তো গুরুত্বহীনভাবে দায়সারাগোছে কিছুটা চলে আসে। অভিযোগ করারও কেউ নাই, ফলে প্রশাসনও নির্বিকার। কারন থানায় অভিযোগ না করা পর্যন্ত সে বিষয়ে মাথা ঘামানো হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে? অভিযোগ করা মানেই তো যেচে পড়ে কুড়ালে পা দিয়ে আঘাত করে আসা। তারচাইতে নীরবে দেশ ছেড়ে, সম্পত্তি ফেলে পাশ্ববর্তী দেশে তৃতীয় সারির নাগরিক হয়ে থাকাটাই তো শ্রেয়। অন্ততঃ প্রাণে বেঁচে থাকা যায় তাতে।

( BD নিউজ পোর্টাল থেকে কপি করা )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন